ই-বইয়ের দুনিয়ায় সারাবিশ্বে প্রায় দেড় কোটি ছাপা বই ডিজিটালে রূপান্তর ‘পিডিএফ’-এর পর এলো ‘ডিজেভিউ’ ফরমেট ছাপা বইয়ের কদর কখনো কমবে না:সংস্কৃতি মন্ত্রী

ই-বইয়ের দুনিয়ায়
বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজ্যাক আসিমভ তার এক লেখায় বলেছিলেন আগামীতে কাগজের বই বলে কিছু থাকবে না। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় কাগজের বই হয়ে যাবে ডিজিটাল। তার কল্পনা একেবারে মিথ্যা হয়নি। সত্যি সত্যিই পৃথিবীজুড়ে ডিজিটাল বই জায়গা করে নিচ্ছে। অনেকে এই ধরনের বইকে ই-বুক বা ই-বই বলেও সম্বোধন করে থাকেন।

ডিজিটাল বইয়ের সঙ্গে পরিচিত এখন অনেকেই। কম্পিউটারে, ল্যাপটপে তো পড়া যায়ই আবার বই পড়বার জন্য ট্যাব অথবা ই-বুক রিডারও পাওয়া যায় বাজারে। কম্পিউটারে টাইপ করা ফাইল কাগজে প্রিন্ট করার প্রয়োজন হয় না বলে ই-বুক কাগজের বই অপেক্ষা দামে সস্তা। কয়েক হাজার ই-বুক ছোট্ট একটা ডিভাইসে সংরক্ষণ করা যায় বলে কাগজের বই অপেক্ষা অনেক হালকা এবং সর্বস্তরের পড়ুয়া বিশেষ করে ছাত্র এবং ভ্রমণকারীদের জন্য সুবিধাজনক। উন্নত বিশ্বে কাগজের বই ছাপার ঝামেলা, খরচ ইত্যাদি নানা কারণে ডিজিটাল বইয়ের চাহিদা বাড়ছে। বাংলাদেশেও সেই জোয়ার এসে পৌঁছেছে। বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখকদের ‘ই-বুক’ পাওয়া যাচ্ছে ইন্টারনেটে। বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকেই পাঠকরা সেসব লেখার স্বাদ নিতে পারছেন।

কয়েকদিন আগেও বাংলা ই-বুক তেমন ভাবে পাওয়া যেত না, অথচ এখন তার ছড়াছড়ি। এমনিতেই পাঠ্য বইয়ের বাইরে বই পড়ার অভ্যাস কমে আসছে বলে নানামুখী আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের সৃজনশীল বই প্রকাশকরা ধুঁকছেন। এ পরিস্থিতিতে ডিজিটাল বইয়ের প্রসার ঘটলে এই প্রকাশনা খাতের অবস্থা কি দাঁড়াবে-সেটা ভাবার  বিষয়। তবে অনেকেই বলেন, বই যতভাবেই পরিবর্তিত বা বিবর্তিত হোক না কেন, কাগুজে বইয়ের আবেদন কোনোদিন ফুরাবে না। কারণ কাগুজে বই পড়া ভারি মজার একটা কাজ, যে বই পড়েছে সেই এ কথাটা জানে। এখন দেখার বিষয় হলো ই-বই আসলেই কি হটিয়ে দিতে পারবে এত দিন ধরে কালজয়ী আবেগ সৃষ্টিকারী কাগজে লেখা বইকে? তবে অনেকের মতে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রবল প্রতিপত্তির যুগেও ছাপা বই তার গুরুত্ব হারায়নি, হারাবেও না। কেননা, নতুন বই কেনার পরে তার প্রচ্ছদ, বইয়ের বাঁধাই সবকিছু মিলিয়ে যে আবেগ জড়িয়ে রয়েছে তা কখনোই পাঠকের মন থেকে হারিয়ে যাবে না। উন্নত বিশ্বে ই-বুক এর জোয়ারের কালেও ছাপা বইয়ের কদর একেবারেই হারিয়ে যায়নি।

এ প্রসঙ্গে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বললেন, ‘ই-বুকের প্রসার যতই হোক না কেন ছাপা বইয়ের কদর কখনো কমবে না। বর্তমান সময়ে ই-বুকের প্রসার বেড়েছে ঠিকই কিন্তু সাধারণ পাঠকের কাছে এখনও বেশি সমাদৃত ছাপার বই। ছাপার বইয়ের অন্যরকম একটা গন্ধ আছে যা এখনও যেকোনো বইপ্রেমিককে মোহিত করে। শুধু তাই নয় বই হাতে নিয়ে পড়ার মধ্যে অন্যরকম একটা আনন্দ আছে।’

গত বৃহস্পতিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ এর প্রস্তুতি দেখতে এসে এমনটাই বলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী। তিনি আরো বলেন, ‘যদি কখনো ই-বুকের প্রসার অনেক বেড়ে যায় তাহলে সেক্ষেত্রে আমরা ই-বুক যারা প্রকাশ করেন তাদেরকে মেলায় জায়গা দেব। তবে বইয়ের কদর কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। মঞ্চনাটক তো এখন আমরা টেলিভিশনেও দেখি কিন্তু সেজন্য কিন্তু টিকিট কেটে মঞ্চনাটক দেখতে আসা দর্শকের সংখ্যা কমেনি বরং বেড়েছে। ভিন্ন মাধ্যমগুলো বিকশিত হবে তার পাশাপাশি ঐতিহ্যের চর্চাও চলতে থাকবে।’

এদিকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ডিজিটাল বইয়ের প্রচলনে সরকার বেশ জোরেশোরেই এগোচ্ছে। এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বললেন, আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রচলিত পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি পরীক্ষামূলকভাবে ৬ষ্ঠ শ্রেণির জন্য ইন্টারএ্যাকটিভ ডিজিটাল টেক্সটবুক চালু করা হবে। পর্যায়ক্রমে তা অন্যান্য ক্লাসের জন্যও করা হবে। নব এ উদ্যোগের ফলে নতুন প্রজন্মের জন্য প্রযুক্তির নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। জানা গেছে, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৬ষ্ঠ শ্রেণির সকল বইয়ের ইন্টারএ্যাকটিভ ডিজিটাল বই তৈরি করা হবে।

ডিজিটাল বইয়ের রকমফের: শুরুতে ডিজিটাল বইকে যেভাবে কল্পনা করা হয়েছিল তা এখন আর নেই। প্রথম দিকে ডিজিটাল বুক বা ই-বুকগুলো কম্পিউটারে পিডিএফ (পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফরমেট) হিসেবে সংরক্ষিত থাকত। তাই অনেকে একে পিডিএফ বইও বলত। এখনও এই পদ্ধতিটি সারা বিশ্বে চালু রয়েছে। ইন্টারনেটে অনেক ওয়েবসাইটে এখনও এই পদ্ধতিতে বই সংরক্ষিত আছে। যা সারা বিশ্বের কোটি কোটি পাঠক নিয়মিত পড়ছে এবং সংগ্রহ করছে। বিশ্বের অনেক ওয়েবসাইট এখন বিভিন্ন জনপ্রিয় পিডিএফ বইগুলো বিনামূল্যে ডাউনলোড করার সুযোগ দিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। কারণ বাংলাদেশের বেশ কিছু ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখকদের বই বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। তবে সময়ের সাথে সাথে এ পদ্ধতিরও কিছুটা উন্নতি ঘটে। পিডিএফ প্রযুক্তির পরবর্তী প্রযুক্তি হিসেবে এসেছে ‘ডিজেভিউ’ (DJVU)। এ পদ্ধতিটির সুবিধা হচ্ছে, এতে বই পড়ার ক্ষেত্রে চোখে চাপ কম পড়বে। পিডিএফে বই পড়ার প্রধান অসুবিধা হল, এতে একসঙ্গে একটির বেশি পৃষ্ঠা পড়া যায় না এবং ছবি প্রকাশের সুবিধাও তেমন নেই। অন্যদিকে ডিজেভিউতে একইসঙ্গে দুই বা এর বেশি পৃষ্ঠা পড়া যায় এবং এ সকল পৃষ্ঠা এমনভাবে দেয়া হয় যাতে ব্যবহারকারীর মনে হয় যে তিনি কোনো কাগজে বাঁধাই করা বই পড়ছেন।

ই-বুক রিডার: আগের পদ্ধতি দুটির জন্য ব্যবহারকারীর কম্পিউটার থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বর্তমান যুগে ডিজিটাল বই পড়ার জন্য আপনার কম্পিউটার থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে যে জিনিসটি থাকতে হবে তা হচ্ছে ডিজিটাল বুক রিডার। এই ডিভাইসটি আকারে ছোট, হালকা এবং সহজে বহনযোগ্য। শুধু তাই নয় এগুলো দেখতেও যথেষ্ট স্মার্ট। বর্তমান সময়ে ই-রিডারগুলোর জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে এগুলো যেমন ছোট এবং হাতব্যাগে বহন করার মতো হালকা, তেমনি পড়ার জন্য একগাদা বই কিংবা সংবাদপত্রের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। ১৯৩০ সালে আমেরিকায় বব ব্রাউন তার সবাক চলচ্চিত্রে প্রথম ‘ই-রিডার’ এর ধারণা দেন। এ সম্পর্কে তিনি একটি বইও লেখেন ‘দি রিডার্স’ নামে। যেখানে তিনি এমন একটি যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন যা মানুষকে পড়তে সাহায্য করবে আর যেখানে অনেক বইয়ের সংগ্রহ রাখা সম্ভব হবে। সেই কল্পনা এখন রীতিমত বাস্তব।

ই-বুকের প্রসারে বইয়ের প্রকাশকরাও বসে নেই। তারাও বুঝতে পেরেছেন যে আগামীতে ব্যবসা ধরে রাখতে হলে তাদের বইকে ডিজিটালে রূপ দেয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই। আর তাই তারাও এখন উঠেপড়ে লেগেছেন বইকে ডিজিটাল করার কাজে। ইতিমধ্যেই সারাবিশ্বে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ বইকে ডিজিটালে রূপ দেয়ার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিদিনই এই সংখ্যা বেড়ে চলেছে। তবে এই কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কপিরাইট আইন। পুরোনো যে বইগুলোর কপিরাইট নেই এখন শুধু সেগুলোকেই বেশ গুরুত্ব দিয়ে জোরেসোরেই ডিজিটাল করার কাজ চলছে। অবশ্য আজকাল অনেক প্রকাশনা সংস্থাই এখন তাদের নতুন প্রকাশিত বইগুলোর ক্ষেত্রে মুদ্রণ এবং ডিজিটাল উভয় সংস্করণেরই কপিরাইট করিয়ে নিচ্ছেন। এরফলে এসব বইয়ের ক্ষেত্রে আর ঝামেলা পোহাতে হবে না। ডিজিটালে রূপায়িত এই বইগুলো বিক্রি করা হবে ই-বুক রিডার ব্যবহারকারীদের কাছে।


ই-বুক পরিবেশবান্ধব:বিশ্বের পরিবেশবাদীরা ই-বুককে স্বাগত জানিয়েছেন। একটি ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পরিবেশবাদীরা ই-বইকে স্বাগত জানিয়েছেন দুটি কারণে, প্রথমত এতে শক্তির ব্যবহার অনেক কম এবং দ্বিতীয়ত এ ধরনের বইয়ের ব্যবহারে কাগজের ওপর থেকে চাপ কমবে। তাদের মতে শুধু মুদ্রণের জন্যই প্রতিদিন বিশ্বে মোট ৭০ মিলিয়ন টন মন্ডের দরকার হয়। আর এ কারণে প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর বনভূমি উজাড় করা হয়। অথচ এ পরিমাণ বনভূমি তৈরিতে সময় লাগে প্রায় ২৫ বছর। এক হিসেবে দেখা গেছে, প্রতিদিন ছাপার ক্ষেত্রে যে পরিমাণ কাগজ লাগছে তার ৬২ শতাংশ ব্যবহূত হচ্ছে সংবাদপত্র শিল্পে আর বাকি ৩৮ শতাংশ ব্যবহূত হচ্ছে বইসহ অন্যান্য মুদ্রণের কাজে। তাই বৃক্ষনিধন রোধে ডিজিটাল প্রযুক্তির বই অভাবণীয় সাফল্য এনে দেবে বলেই ধারণা করছেন পরিবেশবাদীরা।

সংবাদপত্রের ডিজিটাল রূপ: ডিজিটাল রূপে বই আবির্ভাবের অনেক পূর্বেই সংবাদপত্র ডিজিটাল রূপে আত্মপ্রকাশ করে। তবে সংবাদপত্রের ডিজিটাল রূপ কিন্তু ডিজিটাল বইয়ের মত নয়। ডিজিটাল বই পড়ার জন্য যেমন ই-বুক রিডারের প্রচলন হয়েছে সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটি হয়নি। এখন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাই তাদের অনলাইন সংস্করণ বের করছে। এর পাশাপাশি তাদের ই-পেপার সংস্করণও প্রকাশ হচ্ছে। যা মুদ্রিত পত্রিকারই এক প্রকার ডিজিটাল রূপ। বিশ্বখ্যাত পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস ইতিমধ্যেই মাসিক চার্জের ভিত্তিতে তাদের পত্রিকা পড়ার সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিখ্যাত পত্রিকা ‘শিকাগো ট্রিবিউন’ সপ্তাহে তিন দিন তাদের নিউজপ্রিন্ট ভার্সন বের করে বাকি ৪ দিন অনলাইন ভার্সন প্রকাশ করে; যা পাঠকরা অর্থের বিনিময়ে পড়বার সুযোগ পান।

প্রসঙ্গত, ই-বুকের মাধ্যমে পড়াশোনার আগ্রহ আমেরিকায় বাড়ছে। ২০১৪ সালেই ২৮ ভাগ লোকের কাছে ই-বুক ছিল। যা আগের বছর  ছিল ২৩ ভাগ। এই বৃদ্ধির কারণ ৫০ ভাগ আমেরিকানই ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ ই-রিডার বা ট্যাব কিনেছেন, ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ এই হার ছিল ৩০ ভাগ।
Share this article :
 
Copyright © 2014. প্রয়োজনীয় বাংলা বই- AN@MUL - All Rights Reserved
MD ANAMUL AHMED POST